শিক্ষা

আইসোটোপ কাকে বলে ? কত প্রকার ও কী কী?

বিজ্ঞানের জগতে পরমাণু, মৌল ও কণার কথা আমরাতো প্রায়ই শুনি, কিন্তু এগুলোর ভেতরের সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো আমাদের অনেক সময়ই চোখে ধরা পড়ে না। ঠিক তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো আইসোটোপ এর ধারণা। অনেকেই জানতে চান আইসোটোপ কাকে বলে এবং কেন এটি বোঝা অনেক প্রয়োজন। আসলে জেনে অবাক হবেন হয়ত, কোনো মৌলের পরমাণু একই হলেও তার ভরসংখ্যায় কিন্তু ঠিকই পার্থক্য থাকতে পারে, আর এই ভিন্নতার মাধ্যমেই তৈরি হয় এক বা একাধিক আইসোটোপ।

স্কুল-কলেজের পড়াশোনা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, পরিবেশবিজ্ঞান বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইসোটোপের ব্যবহার এত বেশি যে বিষয়টি জানা থাকলে অনেকাংশেই বিজ্ঞানকে বোঝা আরও সহজ হয়।

তাই ইনফো ভান্ডারের আজকেই এই আর্টিকেলে আইসোটোপ কাকে বলে, কীভাবে কাজ করে এবং কোথায় ব্যবহৃত হয় ? এসবের স্পষ্ট ধারণার সাথে সাথে আইসোটোপ নিয়ে যাবতীয় সকল দরকারি তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে চলুন, শুরু করা যাক!

আইসোটোপ কাকে বলে ?

আইসোটোপ কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু একেবারে সহজ। একই মৌলের যেসব পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান থাকে, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যায় পার্থক্য থাকে, সেই পরমাণুগুলোকে একে অপরের আইসোটোপ বলা হয়। অর্থাৎ প্রোটন সংখ্যা একই বলে মৌলের নাম বদলায় না, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা বদলানোর কারণে তাদের ভরসংখ্যা পরিবর্তিত হয়। এ কারণেই একই মৌলের একাধিক আইসোটোপও থাকতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে হাইড্রোজেনকে ধরা যাক। হাইড্রোজেনের তিনটি পরিচিত আইসোটপ হলো প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম এবং ট্রিটিয়াম। তিনটির প্রোটন সংখ্যা একই হলেও নিউট্রন সংখ্যা আবার আলাদা, তাই এরা পরস্পরের আইসোটোপ। একইভাবে কার্বন-১২, কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১৪ হলো কার্বনের আইসোটোপ।

সহজভাবে বলতে গেলে, আইসোটোপ কাকে বলে জানতে চাইলে মনে রাখতে হবে মৌল কিন্তু একই থাকবে, কিন্তু ভরসংখ্যা ভিন্ন হবে। এই ভিন্নতার কারণেই আইসোটোপের ব্যবহার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এত গুরুত্বপূর্ণ।

আইসোটোপ কাকে বলে

পরমাণুর গঠন: প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রনের ভূমিকা

আইসোটোপ কাকে বলে তা পুরোপুরি বুঝতে হলে আগে পরমাণুর গঠন সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। প্রতিটি পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন, আর চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষে আবর্তন করে ইলেকট্রন। প্রোটনের সংখ্যা যার যত সেটার উপরেই মৌলের পরিচিত নির্ভর করে। অর্থাৎ প্রোটন সংখ্যা বদলালে মৌলই বদলে যাবে।

কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা পরিবর্তিত হলেও মৌলের নাম অপরিবর্তিত থাকে। ঠিক এখানেই আইসোটোপের জন্ম হয়। একই মৌলের দুটি বা তার বেশি পরমাণু যদি প্রোটন সমান রেখে নিউট্রনে ভিন্নতা নিয়ে থাকে, তবে তাদের ভরসংখ্যা ভিন্ন হবে (কারণ ভরসংখ্যা = প্রোটন+নিউট্রন সংখ্যা) এবং তারা পরস্পরের আইসোটোপ হিসেবেই পরিচিত হবে।

এ কারণে পরমাণুর ভরসংখ্যা, প্রোটন-নিউট্রনের ভারসাম্য এবং কেন্দ্রে থাকা কণার সংখ্যা আইসোটোপ বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

স্থিতিশীল ও অস্থিতিশীল আইসোটোপ

আইসোটোপ কাকে বলে তা বোঝার পর বোঝা দরকার যে, এগুলো প্রধানত দুই ধরনের হতে পারে স্থিতিশীল এবং অস্থিতিশীল। স্থিতিশীল আইসোটোপের নিউট্রন ও প্রোটনের ভারসাম্য এমনভাবে থাকে যে পরমাণুটি দীর্ঘ সময় একই অবস্থায় টিকে থাকে এবং ভেঙে যায় না। যেমন কার্বন-১২ বা অক্সিজেন-১৬। এরা প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় এবং সাধারণত কোনো বিকিরণ তৈরি করে না।

অন্যদিকে, অস্থিতিশীল আইসোটোপের কেন্দ্রে নিউট্রন-প্রোটনের ভারসাম্য ঠিক থাকে না। ফলে পরমাণু নিজে থেকেই ভেঙে যায় এবং বিকিরণ বা রেডিওঅ্যাকটিভ শক্তি নির্গত করে। এগুলোকে রেডিওআইসোটোপ বলা হয়। উদাহরণ হিসেবে কার্বন-১৪ বা ইউরেনিয়াম-২৩৫ উল্লেখ করা যায়।

স্থিতিশীল ও অস্থিতিশীল আইসোটোপের এই ভিন্ন আচরণই তাদের ব্যবহারকে আরো বেশি বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। কখনও চিকিৎসায়, কখনও গবেষণায়, আবার কখনও শিল্পে এসব আইসোটপের ব্যাবহার দেখা যায়। আইসোটোপ কাকে বলে জানার পর এ দুই ধরনের পার্থক্য বোঝা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আইসোটোপের বৈশিষ্ট্য কী ?

আইসোটোপ কাকে বলে

আইসোটোপ কাকে বলে বুঝে নিলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো জানা আরও সহজ হয়ে যায়। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো ভরসংখ্যার পার্থক্য। একই মৌলের পরমাণু হলেও নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন হওয়ায় তাদের ভরসংখ্যা আলাদা হয়। এর ফলে দুটি আইসোটোপ রাসায়নিকভাবে প্রায় একই রকম আচরণ করলেও ভৌত গুণে পার্থক্য দেখা যেতে পারে, যেমন ঘনত্ব বা স্থিতিশীলতার তারতম্য।

আরও পড়ুনঃ বৃত্ত কাকে বলে ? বৃত্তের বৈশিষ্ট্য ও এর গঠন [2025 Updated]

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো রেডিওঅ্যাকটিভ হওয়ার সম্ভাবনা। কিছু আইসোটোপ স্থিতিশীল থাকে, আবার কিছু অস্থিতিশীল আইসোটোপ বিকিরণ নির্গত করে। এছাড়া ভরসংখ্যার এই ভিন্নতার কারণেই গবেষণা, চিকিৎসা বা শিল্পক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইসোটোপকে আলাদা করে ব্যবহার করা যায়।

মূল কথা, আইসোটোপের পরিচয় তাদের ভর, স্থিতিশীলতা এবং নিউট্রনের সংখ্যার অনুপাতে নির্ধারিত হয়, যা তাদের বিশেষ ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবেই বিবেচিত হয়।

আইসোটোপের ব্যবহার

আইসোটোপ কাকে বলে বোঝার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর ব্যবহার। আইসোটোপের ভরসংখ্যা ভিন্ন হওয়ায় এগুলোকে নানা বৈজ্ঞানিক ও শিল্পক্ষেত্রে আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে রেডিওআইসোটোপের ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয়। যেমন আয়োডিন-১৩১ থাইরয়েড সমস্যার পরীক্ষা ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। একইভাবে ক্যান্সার নির্ণয় ও টিউমারের অবস্থান নির্ধারণে নির্দিষ্ট বিকিরণসমৃদ্ধ আইসোটোপ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে।

গবেষণায় কার্বন-১৪ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইসোটোপ, যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বয়স নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর প্রাচীন জীবাশ্ম থেকে শুরু করে মানবসভ্যতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা জানতে পারি এই আইসোটোপেরই সাহায্যে।

শিল্পক্ষেত্রে আইসোটোপ ব্যবহৃত হয় ধাতুর ফাটল শনাক্ত করা, তেল-গ্যাস এর খোঁজ চালতে, খাদ্য সংরক্ষণ, এমনকি কৃষিক্ষেত্রে মাটির পুষ্টি বিশ্লেষণের মতো কাজেও।

সব মিলিয়ে বলা যায়, আইসোটোপ কাকে বলে জানলে বোঝা যায়, এই ক্ষুদ্র পরমাণুর ভিন্নতা আমাদের জীবন, চিকিৎসা ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে কত বড় ভূমিকা রাখছে এবং রেখে চলেছে।

আরও পড়ুনঃ ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি ফলাফল 2023 (লটারি রেজাল্ট) PDF ডাউনলোড

প্রকৃতিতে আইসোটোপ কোথায় পাওয়া যায়?

আইসোটোপ কাকে বলে

আইসোটোপ কাকে বলে জানার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এগুলো কোথায় পাওয়া যায়? প্রকৃতিতে প্রায় সব মৌলেরই কিছু না কিছু আইসোটোপ স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিতে বিদ্যমান। যেমন অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন বা হাইড্রোজেন প্রতিটি মৌলেরই একাধিক আইসোটোপ পৃথিবীর পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যায়। পানি, বায়ু, মাটি, খাদ্য সব জায়গাতেই এগুলোর ক্ষুদ্র উপস্থিতি থাকেই, যা আমাদের শরীর পর্যন্ত পৌঁছে যায় অনেক সময়।

এ ছাড়া কিছু আইসোটোপ কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা হয় গবেষণাগার বা রিঅ্যাক্টরে নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য। স্থিতিশীল আইসোটোপগুলো প্রধানত প্রকৃতিতে বেশি দেখা যায়, আর অস্থিতিশীল বা রেডিওআইসোটোপ তুলনামূলকভাবে অনেক বিরল।

প্রকৃতিতে এভাবে আইসোটোপের বিস্তৃতি দেখলে বোঝা যায়, এগুলো শুধু বৈজ্ঞানিক ধারণা নয়, আমাদের পরিবেশ ও জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িতও বটে।

বিভিন্ন মৌলের আইসোটোপ

আইসোটোপ কাকে বলে সহজে বুঝতে চাইলে বিভিন্ন মৌলের উদাহরণ জানাই আসলে সবচেয়ে কার্যকর উপায়। হাইড্রোজেন হলো সবচেয়ে ভাল উদাহরণ, কারণ এর তিনটি পরিচিত আইসোটোপ আছে প্রোটিয়াম (নিউট্রন নেই), ডিউটেরিয়াম (একটি নিউট্রন) এবং ট্রিটিয়াম (দুটি নিউট্রন)। তিনটি পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা একই হলেও নিউট্রনের পার্থক্যের কারণে তারা ভরসংখ্যায় আবার ভিন্ন।

আরও পড়ুনঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিলেকশন রেজাল্ট ২০২৪ [পিডিএফ ফাইল]

কার্বন মৌলের ক্ষেত্রেও একই রকম উদাহরণ দেখা যায়। কার্বন-১২, কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১৪ হলো পরস্পরের আইসোটোপ। এর মধ্যে কার্বন-১৪ রেডিওঅ্যাকটিভ হওয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক বয়স নির্ধারণে অনেক ব্যবহার করা হয়।

অক্সিজেনেরও কিন্তু একাধিক আইসোটোপ রয়েছে, অক্সিজেন-১৬, অক্সিজেন-১৭ এবং অক্সিজেন-১৮। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় এবং পরিবেশবিজ্ঞান এর মতো গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার

আইসোটোপ কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তর জানলে পরমাণু, মৌল ও ভরসংখ্যার সম্পর্ক অনেক সহজেই বোঝা যায়। একই মৌলের ভরসংখ্যা ভিন্ন হওয়ার কারণে যে নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়, সেটিই আইসোটোপের মূল পরিচয় হিসেবে কাজ করে।

পরিশেষে, ইনফো ভান্ডারের আজকের আর্টিকেলে আমরা আইসোটোপ কাকে বলে ? এ প্রশ্ন সম্পর্কিত যাবতীয় প্রায় সকল কিছুই জানলাম। আশা করি প্রিয় পাঠক “আইসোটোপ কাকে বলে ?” এ প্রশ্ন নিয়ে প্রায় সকল তথ্যই ভালোভাবেই জানতে পেয়েছেন আমাদের আজকের এই লেখা থেকে!

সবশেষে, আশা করি আমাদের আজকের আর্টিকেলটি আপনার ভাল লেগেছে। কিছুটা হলেও উপকার হয়েছে পাঠকের। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে অনুরোধ থাকবে এই ব্লগ পোস্টটি প্রিয় জনদের সাথে শেয়ার করুন। আর কমেন্ট সেকশনে নিজের মূল্যবান মন্তব্য রেখে যেতে ভুলবেন না কিন্তু! আজকের মতো এখানেই শেষ করছি, দেখা হচ্ছে পরবর্তী কোনো এক লেখায়!

M.A. Habib

আমি এ.এইচ. তূর্য, অজানাকে জানতে ও জানাতে ভালোবাসি। লেখা-লেখির প্রতি আগ্রহ ছিল অনেক আগ থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে "ইনফো ভান্ডার" সহ নিজস্ব কিছু সাইটে নিয়মিত লেখালেখির চর্চা করা হয়। পাঠককে সঠিক তথ্য দিয়ে উপকৃত করাই আমার এই শ্রমের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button